শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মানবিক আবেদন
বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল উপজীব্য রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। রাধা-কৃষ্ণের নামের মধ্যেই আত্মস্থ হয়ে আছে দেব-ভাব, ভক্ত-ভগবানের প্রেম। যদিও এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু এ প্রেম সর্বতোভাবে অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক প্রেমের স্পর্শহীন। এ কাব্যে কৃষ্ণ বার বার নিজেকেক দেবতা বলে প্রচার করলেও বাস্তবতা রাধা-কৃষ্ণ নিছক সমাজ সংসারে সংস্থাপিত দুটি নর-নারী চরিত্র। এ চরিত্র থেকে বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের খোলস ছাড়িয়ে নিলে চিরমানবের রক্ত স্পন্দিত দেহ বিগ্রত বের হয়ে আসে। এ কাব্যের রাধা-কৃষ্ণ রক্তমাংসে গঠিত, প্রাণোত্তাপে সিঞ্চিত। এদের প্রেম কামনার রঙে রঞ্জিত। পূর্ণ প্রস্ফুটিত নারীদেহ যৌবনভরে কাতর, পুরুষের ভোগলিপ্সাকে জাগ্রত ও কামনাকে যে উদ্দীপ্ত করে তোলে তার পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়
কুচযুগ দেখি তার অতি মনোহরে।
অভিমান পাঁআঁ দাড়িম বিদরে।
রাধা ও কৃষ্ণের পরস্পর পরস্পরের কাছে যে দাবি তা ইন্দ্রিয় ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মিলনও দৈহিক। কাব্যের এপার থেকে ওপারে কেবলেই ভোগের প্রচেষ্টা। রাধা নামক মাংসের শরীরে কৃষ্ণের বিহার। দেহ নিয়ে হুলুস্থুল করায় কৃষ্ণকীর্তন অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট। কৃষ্ণের অনাবৃত নির্লজ্জ গোয়ার্তুমিতে এ কাব্যের শিল্পমূল্য অবমানিত ও সৌন্দর্যবোধ ধূলুন্ঠিত।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মানবতা ও বাস্তবতা আমাদের প্রাচীন কাব্য সাহিত্যের একটি সম্পদ। তবে এটি মানবগুণসম্পন্ন কোন ভাস নির্যাস নয়, দৈহিক সীমাবদ্ধ আশা-আকুতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোন উচ্চতর ভাবলোকের কালাকৌতূহল নয়, যে মানুষকে জানি, যাকে বুকের কাছে অনুভব করি, যার মধ্য দিয়ে সাধারণ জীবনের মূর্তিমান হয়ে ওঠে- এ কাব্যে সেই মানবতাকে অভিবাদন জানানো হয়েছে। এ মানবতা দেহ ও প্রাণ উভয়কেই বেষ্টন করে আছে। এতে দেহকে অস্বীকার করা হয় নি। আত্মা দেহকে কেন্দ্র করেই, ত্যাগ করে নয়। তবে তা বৈষ্ণব পদাবলীর অপ্রাকৃত দেহ ধারণ নয়।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে কবি এই দেহকে গ্রহণ করেছেন। তােই তাঁর কাব্যে মানবজীবনের নিজস্ব যে সম্মান, তা আশ্রয় লাভ করেছে। রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রের মাধ্যমেই প্রকৃত মানুষের সাধারণ দেহবোধের পরিচয় মেলে। প্রবৃত্তি ও তার পরিণতির চিত্র আছে এ কাব্যে। মানবিক বৈশিষ্ট প্রবণতা ও ধারণার বৈপরীত্য ঘটানো হয় নি। কবি বাহ্য রূপের ঊর্ধ্বে প্রাণ বা আত্মার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে দেহের মূল্যকে অস্বীকার করেন নি।
একটি বাস্তব পরিবেশে নরনারী যেভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আমরা তার চালচিত্র পাই। গোটা কাব্যখানি দৈহিক আকর্ষণে টানটান। জৈবিক রসে সিঞ্চিত এবং মানবীয় আবেদনে আকর্ষনীয়। এখানে প্রেমের মূল উদ্দেশ্য অশালীন হলেও একান্তই বাস্তব ও মানবিক।
অবশ্য বংশী ও বিরহ খণ্ডে রাধার প্রেমে কিছুটা অন্তরের স্পর্শের সাক্ষ্য মেলে। রাধিকার দেহের ওপর কৃষ্ণের অত্যাচার ঘটেছে ততক্ষণ যতক্ষণ তার মন জাগে নি। কিন্তু বস্তুত ওই দেই মনকে জাগিয়েছে। তাই দেহ ও মন শেষ পর্যন্ত গভীরতর সত্তায় সংযুক্ত হয়েছে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যাকে দেহদান করা হল, তার বিরুদ্ধে হয় প্রেম, নয় ঘৃণা, কোন একটি জাগবেই। রাধার জেগেছিল প্রেম। দেহের সোপন বেয়েই সে প্রেমের পদক্ষেপ। সেখানে তাই পূর্বরাগ নয়, পূর্বভোগ ঘটেছে।
রাধা ও কৃষ্ণের মধ্যে দেহ মিলনঘটিত যে দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে মনের কোন সাড়া ছিল না। কিন্তু মন দেহকে বাদ দিয়ে নয়। তাই কৃষ্ণ রাধার দেহকে যতই ভোগ করেছে, আন্তরিক বিরাগ সত্ত্বেও রাধার চিত্ত কৃষ্ণের প্রতি সেই পরিমাণ আকৃষ্ট হয়েছে। কৃষ্ণ কামনার আদি অধ্যায়ে রাধার মধ্যে হয়ত প্রবৃত্তির তাড়না একটু বেশি পরিমাণে ছিল, কিন্তু যতই দিন গিয়েছে ততই ঐ অসংযত কামনা প্রেমের রূপ ধরেছে। সর্বশেষে রাধার প্রেম যে স্তরে উপনীত হয়েছে তা পরবর্তী বৈষ্ণব ভাবরসের শ্রেষ্ঠ রূপ হয়ত হয় নি, দেহ কামনার রেশটুকু শেস পর্যন্ত তার মধ্যে থেকে গেছে, যা নিতান্ত মানবিক- তবে তার অন্তিম রূপান্তর মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ হৃদয়ধর্মকে উন্মোচিত করে।
একটু ভিন্ন আঙ্গিকে এ কাব্যের মানবিকতা প্রমাণ করা যায়। এ কাব্যে রাধা এগারো বছরের বালিকা। সবে প্রকৃতি তার বুকে এসে ভর করেছে। আর কৃষ্ণও নবীন যুবক। এরা কোন ভাব বৃন্দাবনের চরিত্র নয়। কবি এদের যেভাবে দেখেছেন তেমনই এঁকেছেন। তাদের মুখের ভষা পর্যন্ত তাদের নিজেদের। বাস্তবতা এখানে যে রতি যেহেতু ভাল করে জাগে নি, ফলে সেই রাধাকে দিয়ে কবি আরতি করান নি। সাধারণ গৃহস্থ ঘরের গোপ বালক-বালিকা এ কাব্যের প্রধান চরিত্র। হিঁদুর ঘরের বধূ, মনে সতীত্বের দৃঢ়তা থাকা সত্ত্বেও দেহ মন্থনের মধ্য দিয়ে যে প্রেম জেগেছে, তা দেহকে ছাড়াতে চেয়েও পারে নি, এখানেই এ কাব্যের স্বাভাবিকত্ব, এখানেই মানবিকতা।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের যা কিছু ঐশ্বর্য তা কাব্য থেকে বিচ্ছিন্ন করলে নিতান্ত সাধারণ শ্রেণির মানব-মানবীর সাক্ষাৎ মেলে। মানবিক সম্পর্কের রসটুকু সম্পূর্ণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। মানবত্বকে পৃথক করা সহজ হয়।
তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ভাবময় নয়, জীবনময়। আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বললে- মানব জীবনময়। জীবনমুখী। সুতরাং এ কাব্যের বেদনা বা আনন্দের মধ্যে মানবিকতা স্পষ্ট। জীবনবিমুখতাকে পরিহার করে এ কাব্য হয়ে উঠেছে মানব জীবনমুখী, তথা মানবিক।
Casinos Near Washington, D.C. | Mapyro
ReplyDeleteCasinos 대구광역 출장안마 Near Washington, 광주광역 출장샵 D.C. · 853 밀양 출장안마 Casino St, Washington D.C. · 907 Casino St, Washington D.C. 동두천 출장마사지 · 980 Casino Drive, D.C. 양산 출장마사지 · 980 Casino Drive, D.C.