বাউল সম্রাট লালন শাহ
প্রায় পাঁচশ বছর আগে এদেশে জাতি সম্প্রদায়ের চিহ্নহীন একদল ভক্ত বিশুদ্ধ ঈশ্বরপ্রেমে আত্মনিয়োগ করে এবং সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরকে খোঁজার পথ ও উপায় ব্যক্ত করেছে, তারা সাধারণ মানুষেল কাছে বাউল নামে পরিচিত। এরা অশিক্ষিত ও নিচু জাতের বলে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের কাছে কোনকালেই শ্রদ্ধা বা মর্যাদা পায় নি। তারা অবহেলিত অবস্থায় ছিল। কিন্তু তারা কবেল তাত্ত্বিক নয়, জীবন, সমাজ ও পরিবশে সচেতন। ধনী-নির্ধন, জাতের উুঁচ-নিচু ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা উদার। তাছাড়া মানুষকে তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, তারা সাম্য ও মানবতার প্রতীক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদীদের সমগোত্রীয়। কণ্ঠে তাদের মনবতার গান ও প্রেমের বাণী। রবীন্দ্রনাথ এসব অশিক্ষিত বাউলে প্রতি শিক্ষিত মানুষকে উৎসুক করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ বাউল সম্রাট লালনের সংগীতের ভাব-ভাষা উপমা প্রয়োগ ও গীত মূর্ছনায় আকর্ষিত হন এবং বাউলদের শ্রদ্ধার আসনে বসানোর প্রয়াস পান।
বাউলরা একটু গোপনীয়তা অবলম্বন করে চলে। তাই অধিকাংশ বাউলের শুধু ভণিতা মেলে। তবে লালনের কবিত্ব, ভক্তি ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের জন্য বাউলকুলের শিরোমণি হিসেবে তিনি নন্দিত। রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের বাউল গানের সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হন, প্রধানত তাঁর জন্যই লালন শাহের নাম বাউল সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে প্রচার লাভ করেছে, তাঁর গানগুলো নানাজনে সংগ্রহ করেছেন।
সম্প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর একখানি প্রামাণিক সংকলন সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও তাঁর একাধিক প্রামাণিক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর জীবন ও শিল্পকর্মের ওপর নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্য কিছু দুর্লভ। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় এখনও প্রতিভচর লালনমেলা বসে, এখানেই লালনের আশ্রম ছিল এবং এখন সেটা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা থেকে লালন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তাতে আনুমানিক ঊনবিংশ শতকের প্রথম পাদে কুষ্টিয়ার কুমারখালির কাছে ভাঁড়রা গ্রামে হিন্দু কায়স্থ বংশে তাঁর জন্ম হয়। বিয়ের পর তিনি তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন এবং মুমূর্ষু অবস্থায় পথিমধ্যে পরিত্যক্ত হন। পরে এক নিষ্ঠাবান মুসলমান দম্পতি তাঁকে বাাঁচিয়ে তোলেন। দেশে ফিরলে তার সামনে হিন্দু সমাজের দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেল, তখন তিনি ফকিরি ধর্ম গ্রহণ করে লালন শাহ্ ফকির নামে পরিচিত হন। মুসলমান মোমিন সম্প্রদায়ের অনেকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তিনি উক্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে বিয়ে করে ছেউরিয়া গ্রামে আশ্রম নির্মাণ করে বাউল ও ফকিরি সাধন ভজন করতে থাকেন। তাঁর অনেক হিন্দু শিষ্য ছিল। তিনি বরাবরই জাতপাতহীন বাউল মতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর গানে যেমন হিন্দু মনোভাবদ্যোতক অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি সুফি ধর্মানুমোদিত পারিভাষিক শব্দও প্রচুর পাওয়া যাবে। কোথাও বা তিনি বিশুদ্ধ বৈষ্ণব ভাবের বশে রাধাকৃষ্ণের কথা লিখেছেন, কোথাও বা গৌরাঙ্গ বিষয়ক গানে আত্মনিয়োগ করেছেন। যেমনঃ
বৈষ্ণব ভাবঃ ও গৌরের প্রেম রাখিতে সামান্য কি পারবি তোরা কুলশীল ত্যাগ করিয়া হতে হবে জ্যান্ত মরা।
সুফি ভাবঃ নবীর অঙ্গে জগৎ পয়দা হয়। সেই যে আকার কি হল তার কে করে নির্ণয়।
সীমা, অসীম বা জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্কও তিনি অতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের সাহায্যে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ভাষা স্নিগ্ধ গীতি মূর্ছনায় পূর্ণ, উপমা রূপক, সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের ব্যঞ্জনা এবং ভাবের গভীরতা এ যুগেও বিস্ময়কর। মূলত তিনি বাউল সাধনার সংকেত দিয়ে গানগুলো রচনা করেছেন। তত্ত্বকথা তাঁর ভাষায় বিচিত্র কাব্যশ্রী লাভ করেছে। সর্বোপরি, আধুনিক মনের সাথে তাঁর গানগুলোর আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সেজন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন এবং আধুনিক শিক্ষিত সমাজে তিনি ক্রমশ নন্দিত হচ্ছেন।
জগৎ, জীবন, সৃষ্টি ও স্রষ্টার গভীরতর রহস্য ও তত্ত্ব সহজ ভাষায় লালন ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে সৃষ্টিকর্তাকে বাইরে খুঁজে কোন লাভ নেই, সৃস্টিকর্তাকে খুঁজতে হবে মানুষের দেহের মাঝে, নিজের অন্তরে।
এই মানুষ আছে, রে মন,
যারে বলে মানুষ-রতন
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ
এই দেহে তিনি রয়।
আত্মা রূপেই মানবদেহে পরমাত্মা বিরাজ করে। কাছে থাকে, দেখা যায় না, সে ধরা দেয় না।
(ক) আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
তারে জনমভর একবার দেখলাম না রে।।
কথা কয় রে
দেখা দেয় না।
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনমভর মেলে না।।
(খ) খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
তারে ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম পাখির পায়।।
(গ) লামে আলিফ লুকায় যেমন
মানুষে সাঁই আছে তেমন
(ঘ) লালন মরল জল পিপাসায়
থাকতে নদী মেঘনা।
লালন জাতিভেদ মানতেন না। তাঁর কাছে মানুষই বড়, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়। এ বিষয়ে লালনের স্পষ্ট উচ্চারণ-
(ক) জাতের কিরূপ, দেখলাম না এ নজরে ।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীলোকের কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনী চিনি কি ধ’রে।
(খ) কেউ মালা, কেউ তসবি গলায়,
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।
লালনের অসাম্প্রদায়িক চেতনার নিদর্শন রয়েছে তার গানে হিন্দু-মুসলমান ঐতিহ্য প্রয়োগে ও উভয় ধর্মাশ্রিত শব্দ প্রয়োগে-
(ক) লালন কয় নাম ধরেছে
কৃষ্ণ করিম কালা।
(খ) রামদাস মুচি এই ভবের পরে
পেলো রতন ভক্তির জোরে।
তাঁর মতে প্রকৃতির অপার দানে হিন্দু-মুসরমান সবারই সমান অধিকার-
এক চাঁদে হয় জগৎ আলো
এক বীজে সব জন্ম হলো।
পরমাত্মার অন্বেষণে লালনের গানের জুড়ি নেই।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
আমার বাড়ির কাছে আড়শীনগর
সেথায় এক পড়শী বসত করে।
মানবজীবন লালনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন বহু ভাগ্যের ফলে মানবজীবন প্রাপ্তি ঘটে। মানুষকে জগতের সব প্রাণী, ফেরেশতা, দেবদেবী পর্যন্ত শ্রদ্ধা করে। তাই লালনও মনুষকে ভজন করে।
এই মানুষে আছে, রে মন,
যারে বলে মানুষ-রতন
লালন বলে, পেয়ে সে ধন
পারলাম না রে চিনিতে।।
কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগ সাধনই বাউল পদ্ধতি। এটি অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু লালন এই কঠিন পদ্ধতিক সহজে বর্ণনা করেছেন।
বলব কি সে প্রেমের কথা
কাম হইল প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা
নাইরে আগমন।
সক্রেটিসের Know thyself, হাদীসের কথায়- ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’, বেদের ‘আত্মা নং বিদ্ধি’র মত লালনও বলেছেন-
“আমার আপন খবর আপনার হয় না।
একবার আপনারে চিনিলে পরে যায় অচেনারে চেনা।
লালনের গানে সাধনভজনের উৎকৃষ্ট চিত্র ভেসে উঠেছে-
(ক) বীণার নামাজ তারে তারে
আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।
(খ) যোগ্য পাত্র না হইলে সাধন হবে না।
সিংহের দুগ্ধ স্বর্ণপাত্রে বিনে সে ধন তো রবে না।
গুরুবাদে বিশ্বাসী লালনের কথা সাধনভজন শিখত হলে গুরু ধরতে হবে।
(ক) পরম গুরু প্রেম-পিরীতি
কাম-গুরু হয় নিজ পতি,
কাম ছাড়া প্রেম পাই কি গতি,
তাই ভাবে লালন।।
লালন তত্ত্বকথা প্রচার করেছেন সহজ-সরল উপমার আশ্রয়ে। যা অন্য বাউল থেকে তাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে-
(ক) জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরত গেলে হাতে কে পায়,
(খ) সাঁই নিকট থেকে দূরে দেখায়
যেমন কেশরে আড়ে পাহাড়ে লুকায় দেখ না।
লালনের কিছু যোগসাধনা ও দেহতত্ত্ব বেশ জটিল, যা সাধারণের বোধগম্যে আসে না। সেগুলো বুঝতে বাউল হতে হয়। যেমন-
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কি
ছয় মাসের এক কন্যা ছিল নয় মাসে তার গর্ভ হল
আঠারো মাসে তিনটি সন্তান।
বাউল সংগীতের ও বাউল তত্ত্ব আধুনিক মানুষের কাছে ক্রমশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে মুলত লালনের শৈল্পিক সত্তার কারণে। রবীন্দ্রনাথ লালনের গানে প্রভাবিত হয়ে লালনকে আমাদের কাছের মানুষ করে তুলেছেন। লালনের সমগ্র জীবনের অনেক তথ্যই এখনও গবেষকের গবেষণার প্রতীক্ষায় আছে। শীঘ্রই সমগ্র লালন আমাদের কাছে পরিচিতি পাবে, তখনই লালনের সাধনা হবে সার্থক।
No comments