Header Ads

বাউল গানের ভাব-সম্পদের মৌল প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ

ছবি: সংগৃহিত

বাংলায় বসবাসকারী অনার্যদের মধ্যে নাথপন্থ ও সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল। পরবর্তীতে বাংলার এই অনার্যরা ইসলামে ও বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়। ব্রাক্ষণ্যবাদের অত্যাচারে নিন্মশ্রেণির হিন্দুদের মনে ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রী অধিকারবোধে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, তারেই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদের দিকে পা বাড়িয়ে উদার আকাশতলে স্রষ্টার সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়বার নতুনতর প্রয়াস পেয়ে হয়ে উঠেছে বাউল। কিন্তু তারা পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করতে পারে না বলে ইসলাম ও বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেও নিজেদের পুরনো প্রথায় ধর্মসাধনা করে। তারই ফলে হিন্দু (বৈষ্ণব) ও মুসলমানের সমবায়ে বাউল মতের উদ্ভব হয়েছে। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, মুসলমান মাধববিবি ও আউলচাঁদেই এ মতের প্রবর্তক এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্রই বাউল মত জনপ্রিয় করে তোলে।

বাউল নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, এ নামটি উক্ত সম্প্রদায়ের স্বপ্রদত্ত নয়। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে ও চৈতন্য চরিতামৃতে ক্ষেপা ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে বাউল শব্দের আদি প্রয়োগ দেখা যায়। কেউ বলেন শব্দটি বাউর (অর্থাৎ এলোমেলা,বিশৃঙ্খল, পাগল) থেকে সৃষ্ট।
আবার আকুল থেকে আউল ও ব্যাকুল থেকে বাউল শব্দর সৃষ্টি বলে অনেকে মনে করেন। কারও মতে যারা দীন-দুঃখী এবং উলঝুল একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে ফিরত, বাতুল বলে এদের উপহাস করা হত। পরে বাতুল থেকে বাউল নাম হয়েছে।
কেউ বা বয়ে বায়ু শব্দের সাথে ল প্রত্যয়যোগে বাউল অর্থাৎ বায়ুভোজী উন্মাদ বা শ্বাস-প্রশ্বাসে সাধনকারী অর্থে বাউল শব্দ প্রযুক্ত। উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা অনুমানভিত্তিক হলেও উড়িয়ে দেবার নয়। তবে ব্যাকুল বা বাতুল থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি ধরােই শ্রেয়। কারণ, বাউলো সমাজের উঁচু স্তর থেকে কোন কালেই শ্রদ্ধা বা মর্যাদা পায় নি। তাই ব্যাকুল বা বাতুল (অপদার্থ) অর্থে এদের নামকরণ হয়েছে এটাই মেনে নেয়া যুক্তিযুক্ত।

উঁচু-নিচু ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাউলেরা উদার। তারা সাম্য ও মানবতার প্রতীক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদীদের সমগোত্রীয়। কণ্ঠে তাদের মানবতার গান ও প্রেমের বাণী। আজ সমগ্র পৃথিবীতে যে মানবতার ধ্বনি উচ্চারিত সেই সহিষ্ণুতা পারস্পরিক সম্প্রীতির বাণী বাউলরা পরম নিষ্ঠার সাথে উচ্চারণ করে আসছে। বাউল গান কেবল ধর্মশাস্ত্র নয়, এ গান দর্শন, ভজন সংগীত ও সাহিত্য। বাউল সংগীত কেবল লোকসাহিত্য নয়, এগুলো এদেশের সাধারণ মানুষের প্রাণের কতা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির ফসল। বাউল গানের মধ্যে পরমাত্মা, মনের মানুষ, গুরুবাদ, কাম দেহতত্ত্ব, আত্মাকে চেনা, ভজন সাধন, মানুষ, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি অনুষঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে।
বাউলদের মতে জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মা প্রোথিত। সক্রেটিসের Know theyself, বেদের ‘আত্মানং বিদ্ধি’, হাসিদের কথায়- ‘মান আরফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’- এর মত বাউলরাও নিজেকে জানা ও নিজের আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে সৃস্টিকর্তাকে পেতে চায়। নিজ আত্মার স্বরূপ উপলব্দির সাধনাই বাউলদের ব্রত।মানবজীবনের চরম ও পরম সাধনা খোদাকে চেনা। নিজেকে না চিনলে খোদাকে চেনা যায় না। রূপক অভিব্যক্তিতে বাউলরা পরমাত্মাকে মনের মানুষ, অধর মানুষ, মানুষ রতন, অচিন পাখি, অলখ সাঁই ইত্যাদি বলেছেন।
খুঁজি তারে আসমান-জমি
আমারে চিনি নে আমি,
এ কি বিষম ভুলে ভ্রমি-
বাউল তত্ত্ব রপকের আবরণে আচ্ছাদিত। তবে সে রূপক দেহাধার, বাহ্যবস্তু, ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও প্রচেষ্টা থেকে গৃহীত। দেহের আধারে যে চেতনা তারিই নাম আত্মা। নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ সন্ধানে শরীরতত্ত্বে মানুষ কৌতূহলী হয়েছে। দেহ নিরপেক্ষ আত্মার কোন অস্তিত্ব যখন নেই তখন আত্মার স্বরূপ দেহ বিশ্লেষণে জানা সম্ভব। এভাবেই সাধনতত্ত্বে দেহবাদ এসেছে। বাউলদের মতে যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে।
বাউলরা যে অধ্যাত্ম সাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন, তাকে যেমন বিশুদ্ধ মনোমার্গে উপলব্ধি করত, তেমনি আবার স্থূল দেহমার্গে ও রহস্যময় অনুশীলনের দ্বারা তাকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মধ্যে আনতে চায়। সেই প্রক্রিয়াটি কিছু তন্ত্র, কিছু যোগ, কিছু হঠযোগের ধারা অনুসরণ করে। প্রাণায়ামের সাহায্যে দেহের মধ্যে মুক্তি সন্ধান করত। এর আরও একটা গূঢ় গোপন সাধনা পদ্ধতি আছে, যার কথঅ অ-বাউলদের জানা নিষেধ। নর-নারীর দেেই সে সাধনার যজ্ঞদেবী, নানা রহস্যময় প্রতীকের সাহায্যে সেই কথার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

“ত্রিবেণীর তীর ধঅরে সুধারে জোয়ার আসে।
সুখ সাগরে মানুষ খেলে বেহাল বেশে।”

কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগ সাধনাই বাউল পদ্ধতি। এটি অত্যন্ত কঠিন। ইন্দ্রিয় নিরোধ, বিষয় ত্যাগ বা বৈরাগ্য এদের লক্ষ্য নয়। এরই নাম সহজযান, বাউলরা সহজিয়া।

“বলব কি সে প্রেমের কথা,
কাম হইল প্রেমের লতা,
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা
নাই রে আগম।”

বাউল গানের মধ্য দিয়ে বাউলেরা উৎকৃষ্ট ভজন সাধন চালায়।
(ক) বীণার নামাজ তারে তারে
আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।

(খ) সখি গো, জন্ম মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙেয্গ প্রেম গো চাই।
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্বসার।
তীর্থ ব্রত যাহার জন্য
এ দেহে তার সব মেলে।

(গ) অনুরাগ নাইলে কি সাধন হয়।
সে তো শুধু মুখের কথা নয।।
তার সাক্ষী আছে চাতক রে,
ও সে কোন সাধনে যায় মরে,

তাদের মতে সৃষ্টিকর্তাকে বাইরে খুঁজে কোন লাভ নেই, সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে হবে মানুষের দেহের মাঝে, নিজের অন্তরে। মানবাত্মার শ্রেষ্ঠত্বই পরমাত্মা।

(ক) এই মানুষে আছে, রে মন,
যারে বলে মানুষ-রতন,
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ
এই দেহে তিনি রয়।

(খ) দেহের মাঝে আছে যে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।

(গ) আপনার আপনি যদি চেনা যায়
তবে তার চিনতে পারি সেই পরিচয়।

বাউলদের মতে আত্মারূপেই মানবদেহে পরমাত্মা বিরাজ করে। কাছে থাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না।

(ক) আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
তারে জনম-ভর একবার দেখলাম নারে।।
কথা কয় রে
দেখা দেয় না
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম ভর মেলে না।।

জীবনন ও সমাজ সচেতন বাউল জাতিভেদ সম্বন্ধে বলেছে-

(ক) জাতের কিরুপ দেখলাম না এ নজরে।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীলোকের কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনী চিনি কি ধরে।।

(খ) রাম কি রহিম সে কোন জন,
মাটি কি পবন জল কি হুতাশন,
শুধাইলে তার অন্বেষণ
মূর্খ দেখে কেউ বলে না।।

ধর্মভেদ সর্ম্পকে বাউলদের বক্তব্য-
(ক) তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজিদে
ও তোর ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই
আমায় রুখে দঁঅড়ায গুরুতে মুর্শীদে।

মানবজীবন বাউলদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা মনে করেন বহু ভাগ্যের ফলে মানব জীবন প্রাপ্তি ঘটে। মানুষকে জগতের সব প্রাণী ভজন করে এমন কি ফেরেশতা, দেবদেবী পর্যন্ত। তাই মানুষই বাউলদের ভজনযোগ্য।

(ক) এই মানুষে আছে, রে মন,
যারে বলে মানুষ-রতন,
লালন বলে, পেয়ে সে ধন
পারলাম না রে চিনিতে।
বাউলেরা গুরুবাদে বিশ্বাস করে। তাদের যোগসাধনা গুরুর কাছ থেকে শিখে নেয়-

(ক) হা রে সুজনের সঙ্গ ধর
গুরু ধনের কারবার কর।
সদা গুরুর নাম স্মর।

বাউল তত্ত্ব বিবিধভাবে  ব্যজ্ঞিত হয়েছে-
(ক) উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থ ব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সব মিলে।

(খ) ছয় রিপুর বশ করিয়ে
আল্লার নামের পেরেক দেও আটিয়ে।

বা্উলেরা অশিক্ষিত। তাদের শাস্ত্রের কোন লিখিত দলিল নেই। তাদের মতবাদের কালিক বা দার্শনিক পরিচয়ও মেলে না। সমাজের অশিক্ষিত ও নিচু তলার মানুষের ধর্ম বলে উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত লোকের এদের সর্ম্পকে কৌতূহল জাগে নি। রবীন্দ্রনাথই এদের প্রতি শিক্সিত মানুষকে উৎসুক করে তোলেন। তিনি নিজেও বাউল প্রভাবিত হয়ে অনেক গান রচনা করেছেন।

(ক) আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আমি তাই হেরি তায় সকল খানে।

(খ) আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছি।
দেখতে আমি পাই নি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাই নি।


মোটামুটি সতের শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে বাউল মতের উন্মেষ। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মধ্যে এর পরিপূর্ণ তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.