বাংলা সাহিত্যে শ্রীকৃষ্ণকৃর্তীন কাব্যের সার্থকতা
![]() |
ছবি: সংগৃহিত |
বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তেরটি খণ্ডে কাহিনী বিধৃত।
কাহিনীঃ ধূর্ত শ্রীকৃষ্ণ ছলেবলে কলেকৌশলে কিশোরী অনভিজ্ঞ গোপবধূ রাধার প্রথমে দেহ ও পরে মন কেড়ে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে যায়। রাধা প্রথমে কৃষ্ণকে ঘৃণা করলেও ধীরে ধীরে সে কৃষ্ণপ্রেমে আসক্ত হয়। প্রথমে কৃষ্ণ রাধার জন্য ব্যাকুল হয়, অতঃপর প্রণয় ব্যাকুলা বিরহ বিধুরা রাধার বুকফাটা ক্রন্দনে কাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটে।
চরিত্রঃ কাব্যটির কাহিনী কৃষ্ণ, রাধা ও বড়াই- এই তিনটি চরিত্রের সক্রিয়তার মধ্যে পরিণতি পেয়েছে। কৃষ্ণ চরিত্রের কোন বিবর্তন নেই, সে আপাদমস্তক কামুক। কাব্যের শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ চরিত্রের ঝোঁক কেবল রাধা নামক কিশোরীর দেহের পাড় ভাঙতে, তার সকল সক্রিয়তা রাধার দেহ সম্ভোগে।
রাধা এ চরিত্র এ কাব্যের সর্বোজ্জ্বল চরিত্র। সে গোপবধূ। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাখাল কৃষ্ণ তাকে প্রস্তাব পাঠালে সে তা প্রত্যাখ্যান করে। কৃষ্ণ নানাভাবে চেষ্টা করে তার দেহকে ছুঁয়ে দিতে। ছলে-বলে-কৌশলে কৃষ্ণ তাকে ভোগ করে। রাধার এতদিনের বিশ্বাস শিথিল হয়ে আসে। সেও ধীরে ধীরে কৃষ্ণের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কাব্যের শেষে কৃষ্ণবিরহে উন্মত্ত রাধার সজল চোখ আমাদের চোখে ভাসে। রাধাকে দেবী হিসেবে পূজা যেমন দেয়া যায়, তেমনি মানবী হিসেবে বুকে নেয়া যায়। বড়াই এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের মিলনের মাধ্যম হিসেবে সক্রিয়। তার মানবিক চরিত্র আমাদের মুগ্ধ করে। কৃষ্ণ যখন রাধারবিরহে ব্যাকুল তখন সে কৃষ্ণের প্রতি সহানুভূতিশীল। আবার রাধা যখন কৃষ্ণবিরহে ব্যাকুল তখন বড়াই রাধার বেদনায় মুহ্যমান। বড়াই মানবিক চরিত্রের দ্যোতক।
রসঃ জন্ম খণ্ড হতে রাধাবিরহ পর্যন্ত শৃঙ্গার-হাস্য-করুণ কোন রসেরই অভাব নেই। জন্ম খণ্ডে নারদের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে হাস্যরসের উদ্রেক হয়েছে। বড়াইয়ের মুখে রাধার রূপ শুনে কৃষ্ণের প্রেমভাব, কৃষ্ণের প্রেম প্রস্তাব প্রেরণ, দান খণ্ডে দানী সেজে কৃষ্ণের রাধাকে প্রতারণা, নৌকা খণ্ডে কৃষ্ণ কর্তৃক গোপীদের বস্ত্রহরণ, হার খণ্ডে, হার অপহরণ, রাধা কর্তৃক বংশী অপহরণ ও মিথ্যা কথন ইত্যাদি ক্ষেত্রে লঘু রসের প্রবাহমানতা লক্ষ্য করা যায়। রাধা-কৃষ্ণ প্রথমদিকে যে চটুল কথা বলেছে তা গ্রাম্য মানুষের জন্য উপাদেয়। কৃষ্ণকে রাধার ভার বইতে দেখে হাসি পায়। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার রান্না এলোমেলো হওয়ার অসংগতি হাস্যরসের উদ্রেক করে।
অতিকথনঃ দীর্ঘসময় ধরে নানা অনুচ্ছেদে একই কথা বার বার বলাতে এক ধরনের বিরক্তির উৎপত্তি হয়। কৃষ্ণ রাধাকে হাজার বার রতিদানে আহ্বান জানায়। আবার রাধাও একই যুক্তি বার বার দেখায়। কাব্যের পরিণতিতে রাধা কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হয়ে বড়াইকে একই কথা বার বার বলে যা কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করে।
উপমাঃ কবি এ কাব্যে সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র থেকে উপমা যেমন নিয়েছেন, তেমনি পল্লীর জীবনযাত্রা থেকেও সংগ্রহ করেছেন উপমা। সংস্কৃত অনুসারী উপমায় কবির মৌলিকত্ব নেই, করিব মৌলিকত্ব গ্রাম্য জীবন থেকে নেয়া উপমায়।
সংস্কৃত অনুসারী উপমায় কবি রাধা-কৃষ্ণের বড়াইয়ের রূপ বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন -
(ক) কেশপাশে শোভে তার সুরঙ্গ সিন্দুর।
সজল জলদে যেহ্ন উঠল নবসুর।
(খ) কুচযুগ দেখি তার অতি মনোহারে।
অভিমান পাঁআাঁ দাড়িম বিদরে।
গ্রাম্য উপমায় শিল্পীর মৌলিকত্ব আছে-
(ক) বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জানী।
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভোরের পণী।
(খ) আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে
যেহ্ন ঝরএ নয়নের পানি।
(গ) সুধিলোঁ সখির ঝোলে সজল নলিনী দলে
তাতে হৈতেঁ আনল শীতলে।
(ঘ) এবে মোর মনের পোড়ণী
যেন উয়ে কুম্ভারের পণী।
(ঙ) পোটলী বান্দিআ রাখ নহুলী যৌবন।
(চ) কাহ্ন বেণী সব ঘন পোড়া এ পরাণী
বিষাইল কাঙ্গের ঘা এ যেহেন হরিণী।
শ্রীকষ্ণকীর্তন কাব্যে যে প্রতিবেশ বর্ণনা তা আলম্বন বিভাবের কাজ করেছে। যেমন-
(ক) বহে প্রভাত সমএ মলয় শিয়ল বাএ
বৃন্দাবনে কুয়িলী কাঢ়ে রাএ।
(খ) মুকলিল আম্ব সাহারে। মধু ভেঁ ভ্রমর গুজরে।
(গ) ডালে বসী কুয়িলী কাঢ়ে রাঁএ
যেহ্ন লাগে কুলিশের ঘাএ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বেশকিছু প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে-
(ক) লালট লিখিত খণ্ডন না জাএ।
(খ) আম্মাকে বল কৈলে তোর নাহি কিছু ফল।
মাকড়ের সাথে যেহ্ন ঝুনা নারিকেল।
(গ) অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।
(ঘ) মাকড়ের যোগ্য কঁভো নহে গজমুতী।
গীতিময়তাঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের গোড়ার দিকে ঝুমুর শ্রেণীর লোকসংগীতের প্রভাব আছে। তবে বংশী খণ্ড ও রাধাবিরহ খণ্ডে সে সুর গীতিকবিতার উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিছুটা পথ নাকীয় চঞ্চলতা ও দ্রুততা থাকলেও কাব্যের শেষদিকে গীতিকবিতার গভীরতার মধ্যে মিলিয়ে গেছে।
কাহ্নাঞিঁ বিহানে মোর সকল সংসার ভৈল
দশ দিগ লাগে মোর শুন।
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন
ঝরএ নয়নের পানী।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অনেক পদ ভাব-গভীরতায় সমৃদ্ধ এবং সে সকল পদে কবির ব্যক্তিগত অনুভূতিই সহজ সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
নাট্যগুণঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের অধিকাংশ পদ রাধা-কৃষ্ণ ও বড়াইয়ের উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে নাট্যসংলাপ গুণধর্মী। জন্ম খণ্ডের পর থেকে প্রায় সমগ্র কাব্যখানিই রাধা-কৃষ্ণ-বড়াইয়ের কথোপকথন ও সংলাপে গঠিত। তাছাড়া নাটকের প্রধান গুণ বাস্তবধর্মিতা, এ কাব্যের নায়ক-নায়িকার দ্বন্দ্ব-কলহ, মন-মেজাজের উত্তাপ, মিলন-বিরহ সবই কবির অভিজ্ঞতা প্রসূত।
বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে অতিকথন দোষ এবং কৃষ্ণের দেহসম্ভোগের বাতুলতা বাদ দিলে কাহিনী গ্রন্থনের পারঙ্গমতা, চরিত্র চিত্রণের দক্ষতা, রস, উপমা, নাটকীয়তা, গীতিধর্মিতা মিরে এটি একটি সার্থক কাব্য পদবাচ্য।
সর্বোপরি, এ কাব্যের মধ্য দিয়ে কালিন্দী নদীর কূলে গোকুলের গোঠে অবিরত যে বংশী ধ্বনি হচ্ছে, কবি বাঙালি জাতিকে সেই দূরাগত প্রতিধ্বনি শুনিয়ে গেছেন। সেই বঁশির স্বরে সকল তত্ত্বকথা ও শাস্ত্রকথা অতিক্রম করে শ্রেষ্ঠ এ কাব্যের গীতিমূর্ছনা আমাদের কর্ণে আছড়ে পড়ে। এখানেই এ কাব্যের সর্বৈব সার্থকতা।
No comments